সম্পাদক ও প্রকাশকঃ
মোঃএমদাদুল হক মিলন
শতবর্ষ প্রাচীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের উদ্দেশ্যে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। এ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে অত্যন্ত গোপনে, অতি দ্রুততার সঙ্গে এবং প্রত্যাশিত সংস্থাসমূহ, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনকে অজ্ঞাত রেখে। অথচ সরকার সামগ্রিক সংস্কার কার্যক্রম একটি কাঠামোবদ্ধ (systematic) প্রক্রিয়ায় শুরু করেছিল। প্রথমে খাতভিত্তিক কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়; কমিশনসমূহ তাদের প্রতিবেদন প্রদান করে। পরবর্তীতে এসব প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য একটি ‘ঐক্যমত কমিশন’ গঠিত হয়, যারা রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাজস্ব বোর্ড সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকার একটি পৃথক পরামর্শক কমিটি গঠন করে। উক্ত কমিটির প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি, তাদের সুপারিশ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করা হয়নি, প্রত্যাশী সংস্থাসমূহ, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়নি। এরপর, হঠাৎ করেই মধ্যরাতে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
এ অবস্থায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্তি এবং সার্বিক রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার ইস্যুতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের বক্তব্য নিম্নরূপ:
বর্তমানে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ রাজস্বের প্রায় ৮৬ শতাংশই এনবিআরের মাধ্যমে আহরিত হয়, যা জাতীয় উন্নয়ন ব্যয়ের বড় অংশে সরাসরি অবদান রাখে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৬৬ কোটি টাকা। দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিকতায় এই পরিমাণ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩,৮২,৬৭৮ কোটি টাকায়। এই দীর্ঘ সময়জুড়ে রাজস্ব আহরণের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৬.৪৪ শতাংশ, যা যেকোনো রাজস্ব কর্তৃপক্ষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ও মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। এই অর্জন প্রমাণ করে যে, সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এনবিআর তার দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকেছে।
১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ৭৬ নম্বর আদেশ (National Board of Revenue Order, 1972) মূলে গঠিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে এ পর্যন্ত ৫৩ বছরে মোট ৩১ জন চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করেছেন। আদেশ মোতাবেক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সিনিয়রমোস্ট সদস্য চেয়ারম্যান হিসেবে পদায়নের কথা লেখা থাকা সত্ত্বেও বিগত সময়ের প্রায় সব চেয়ারম্যানই এসেছেন কাস্টমস ও কর ক্যাডারের বাইরে থেকে। প্রত্যেক চেয়ারম্যানের গড় মেয়াদ মাত্র ১.৭ বছর। চেয়ারম্যানদের স্বল্প মেয়াদ এবং আয়কর আইন, কাস্টমস আইন, ভ্যাট আইন ব্যবস্থাপনায় বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাব বোর্ডের অভ্যন্তরীণ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার কার্যকারিতাকে হ্রাস করেছে।
১৯৭৯ সালে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ গঠিত হওয়ার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে উক্ত বিভাগের রাজস্ব উইং হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও বাস্তবে এনবিআর নিজস্ব ক্ষমতা ও স্বাতন্ত্র্য প্রয়োগ করতে পারেনি। বরং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিবকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়, যার ফলে একই ব্যক্তির অধীনে দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব কেন্দ্রীভূত হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এ ধরনের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা থাকায় বোর্ডের নীতিনির্ধারণী ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে ভারসাম্যহীনতা ও সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি করেছে। বোর্ডের নীতিনির্ধারণী ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে ক্ষমতার ভারসাম্যের অভাব একটি দক্ষ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাজস্ব প্রশাসন গঠনের পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ১০০ টাকা রাজস্ব আদায়ের বিপরীতে ব্যয়ের পরিমাণ মাত্র ৩১ পয়সা, যা বৈশ্বিক বিবেচনায় সর্বনিম্ন। তুলনামূলক বিচারে দেখা যায়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতি ১০০ রুপি রাজস্ব আদায়ের বিপরীতে ব্যয় হয় ৬১ পয়সা, মালয়েশিয়াতে প্রতি ১০০ রিঙ্গিতে রাজস্ব আদায়ের বিপরীতে ব্যয় হয় ১ রিঙ্গিত এবং জাপানে প্রতি ১০০ ইয়েন রাজস্ব আদায়ের বিপরীতে বিনিয়োগ করা হয় প্রায় ১.৭ ইয়েন। অর্থাৎ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অপ্রতুল বিনিয়োগের মধ্যেও স্বাধীনতার পর থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গড়ে ১৬.৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে রাজস্ব আহরণ করেছে, যা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আন্তরিক প্রচেষ্টা, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের ফলাফল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভালো, রাজস্ব আহরণ সংক্রান্ত বিনিয়োগের সাথে কর-জিডিপি অনুপাত উন্নয়নের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোয় দ্বিস্তর বিশিষ্ট প্রশাসনিক অনুমোদন ব্যবস্থা বিদ্যমান। বোর্ডের নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো থেকে অনুমোদনের পর অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের অনুমোদন গ্রহণ বাধ্যতামূলক। এই দ্বিস্তর অনুমোদন ব্যবস্থার কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে মারাত্মক দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি হয়। সুতরাং নেতৃত্বের দুর্বলতা, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক বিচ্যুতি, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও দক্ষ মানবসম্পদের অভাব এবং প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের ঘাটতি, বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামোয় জটিলতা, এই সবকটি বিষয়ই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমকে ব্যাহত করেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সম্পর্কে একটি ধারণা হলো, এটি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। বাস্তবতা হলো, দুর্নীতি বাংলাদেশের একটি বিস্তৃত কাঠামোগত সমস্যা, যা শুধু এনবিআর নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি খাতেই কোনো না কোনোভাবে বিদ্যমান। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের খানা জরিপ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৩ সালের খাতভিত্তিক দুর্নীতির তালিকায় কর ও কাস্টমসের অবস্থান ছিল ১৪তম, যেখানে ২০২১ সালে এ খাতটি শীর্ষ ১৫-এর বাইরে ছিল এবং ২০১৭ সালে ছিল ১৩তম অবস্থানে। এই চিত্র বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, এনবিআরের দুর্নীতি প্রচলিত ধারণার বিপরীত।
বর্তমান প্রশাসন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে অটল। যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, প্রশাসনিক তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এনবিআরের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এই দুর্নীতির অপবাদ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।